তুলার সাথী ফসল
এক খন্ড জমিতে একই সাথে কোন প্রধান ফসলের পাশাপাশি স্বল্পসময়ের জন্য অতিরিক্ত হিসেবে দুই বা ততোধিক ফসল চাষের পদ্ধতিকে সাথী ফসল চাষ বলা হয় এবং অতিরিক্ত ফসলটিকে বলা হয় সাথী ফসল৷ তুলার সাথে সাথী ফসল চাষের প্রধান উদ্দেশ্য হলো একই সাথে একই জমিতে একাধিক ফসল আবাদ করে অধিক মুনাফা অর্জন করা৷
সাথী ফসল চাষের উপকারিতা
(১) |
একক ফসলের চেয়ে আন্ত:ফসল চাষ করে মোট উৎপাদন বেশী পাওয়া যাবে এবং মোট আয় বৃদ্ধি পায়৷ |
(২) |
আন্ত:ফসল চাষে জায়গা ও সময়ের সদ্ব্যবহার করা যায়৷ |
(৩) |
কোন কারণে একটি ফসল নষ্ট হলে অন্যটি দ্বারা ক্ষতিপ‚রণ সম্ভব৷ |
(৪) |
এতে প্রাকৃতিক সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার হয়৷ |
(৫) |
ভ‚মি ক্ষয় ও আগাছার প্রকোপ কম হয়৷ |
সাথী ফসল নির্বাচন
সঠিক সাথী ফসল নির্বাচন যেমন একজন চাষিকে অত্যন্ত লাভবান করতে পারে, তেমনি ভুল ফসল নির্বাচনের ক্ষেত্রে চাষি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই সাথী ফসল নির্বাচনে নিম্নোক্ত বিষয়াবলী মনে রাখতে হবে:-
(ক) |
সাথী ফসলের বৃদ্ধি ও পরিপক্কতার সময় মূল ফসলের বৃদ্ধি পরিপক্কতার সময়ে ভিন্নতা থাকবে৷ |
(খ) |
সাথী ফসল যেন তুলার সাথে আলো, বাতাস, পানি, খাদ্যোপাদান এবং জায়গা নিয়ে কোন প্রতিযোগিতা না করে৷ |
(গ) |
সাথী ফসলের ক্ষতিকর প্রভাব যেন তুলার ওপর না পড়ে৷ |
(ঘ) |
সাথী ফসলের পরিচর্যা পদ্ধতি যেন তুলার পরিচর্যার সাথে মিল থাকে৷ |
(ঙ) |
সাথী ফসলের পোকা-মাকড় ও রোগ-বালাই যেন তুলা ফসলকে আক্রমণ না করে৷ |
(চ) |
তুলা গাছকে পেঁচিয়ে আরোহণ করতে পারে এমন সাথী ফসল অন্তভ‚র্ক্ত করা যাবে না৷ |
তুলার সাথে মুগ ও মাস চাষ
২-৩টি চাষ দিয়ে জমি প্রস্তুত করে নিতে হবে৷ জুলাই-আগষ্ট মাসে দুই সারি তুলার মধ্যে এক সারি করে লাইনে মুগ/মাসকলাই বীজ বপন করতে হবে৷ তুলা বীজ বপনের সময় মুগের বীজের বপন দুরত্ব ৭-৮ সেঃ মিঃ রেখে বপন করতে হবে৷ জমিতে রস কম থাকলে বপনের পূর্বে বীজতুলা ৩/৪ ঘন্টা পানিতে ভিজিয়ে বপন করা ভাল৷ উলেৱখ্য, বপনের সময় লাইনে পাতলা করে অনবরত বীজ দিয়ে পরবর্তীতে চ‚ড়ান্ত ভাবে চারা পাতলা করে গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৭-৮ সেমিঃ এর মধ্যে রাখা যায়৷
তুলার আইলে ফাঁদ ফসল চাষ ঃ তুলা জমির আইলে গাঁদা ফুল, ভুট্টা, অড়হর, ঢেঁড়স, বরবটি, সীম, তিল ইত্যাদি ফসল চাষ করা হলে একদিকে এগুলো যেমন তুলার পোকার ফাঁদ ফসল হিসেবে কাজ করবে, অপরদিকে বাড়তি আয় পাওয়া যাবে৷
তুলার সাথে তিল: দু’লাইন তুলার সাথে এক লাইন তিল একই সময় শ্রাবণ মাসে বপন করা যায়৷
তুলার সাথে চীনাবাদাম: শ্রাবণের শেষে তুলা এবং বাদাম একই সাথে লাগাতে হয়৷ দু’লাইন তুলার মাঝে দু’লাইন বাদাম ৩০ সে:মি: ´ ১৫ সে:মি: দূরত্ব দিয়ে লাগাতে হয়৷
তুলার সাথে শাক-সব্জি চাষ: তুলা বপনের পর দু’সারির মাঝে স্বল্পমেয়াদী শাকসব্জি শ্রাবণ মাসে ছিটিয়ে বপন করতে হয়৷ সব্জি চারা গজানোর ৭-৮ দিন পর বিঘা প্রতি ৫-৮ কেজি ইউরিয়া সার ছিটাতে হয়৷ এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে সব্জি খাবার উপযুক্ত হয় এবং নিড়ানী দেয়ার সময় তুলে ফেলতে হয়৷ লাল-শাক, ডাটা-শাক, মূলা-শাক, কলমী-শাক, ধনে পাতা সাথী ফসল হিসাবে চাষ করা যায়৷ গীমা কলমীর বেলায় দু’লাইন তুলার মাঝে দু’লাইন গীমা কলমী ১৫ সে:মি: ´ ১০ সে:মি: দূরত্ব দিয়ে লাগাতে হয়৷ ২০-২৫ দিনে প্রথম কলমী শাক সংগ্রহ করা যায়৷ সংগ্রহের পর বিঘাপ্রতি ৫-৮ কেজি ইউরিয়া ছিটাতে হয়৷ এভাবে প্রায় তিনবার কলমী শাক সংগ্রহ করা যায়৷ এছাড়া, তুলার সাথে সাথী ফসল হিসাবে আরলি-৪০ জাতের মূলা, শসা, বাঁধাকপি, ফুলকপি চাষ করা যায়৷
তুলার সাথে রিলে ফসলের চাষ পদ্ধতি
আদা/হলুদের সাথে তুলার চাষ: বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে ৯০ সে:মি:´২০ সে:মি: দ‚রত্ব দিয়ে আদা/হলুদ লাগাতে হয়৷ এর পর শ্রাবণ মাসে দু’লাইন আদা/হলুদের মাঝে এক লাইন তুলার বীজ ৪৫ সে:মি: অন্তর ডিবলিং পদ্ধতিতে বপন করতে হয় এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা অব্যাহত রাখতে হয়৷
কলার সাথে তুলার চাষ: সম্প্রতি কলা ক্ষেতের মধ্যে সাথী ফসল হিসেবে তুলা উৎপাদন করা হচেছ৷ কলার চারা যখন ছোট থাকে এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ৬-৯ ফুট, তখন এ ফাঁকা জায়গায় সারিতে ডিবলিং পদ্ধতিতে শ্রাবণ মাসে তুলাবীজ বুনে সাধারণ নিয়মে তুলা উৎপাদন করা যায়৷ তবে নতুন কলা বাগানে প্রথম বছরে কেবল তুলা ভালো হয়৷
নতুন বাগানে তুলার চাষ: নতুন ফল বাগান যেমন- আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি অথবা অন্যান্য গাছের বাগান যেমন- মেহগনি ইত্যাদিতে প্রথম ২/৩ বছর অনায়াসে তুলার চাষ করা যায়৷ বাগানের গাছের দু’সারির মাঝে চাষ ও মই দিয়ে জমি তৈরি করে নির্দিষ্ট দূরত্বে তুলাবীজ বপন করা যায়৷ এতে বাগানের পরিচর্যার পাশাপাশি তুলা থেকে বাড়তি লাভ পাওয়া যায়৷
মরিচের সাথে তুলার চাষ: মার্চ থেকে মধ্য এপ্রিলের মধ্যে বৃষ্টিপাত শুরূ হলে বারি মরিচ-১ জাত (বাংলা লংকা) ৪০ সে:মি:´৩০ সে:মি: দূরত্ব দিয়ে লাগাতে হয়৷ এরপর জুলাই-আগস্ট মাসে দু’সারি মরিচ মাঝে ১ সারি তুলা ডিবলিং পদ্ধতিতে বপন করতে হয়৷ মরিচ গাছ মরে যেতে থাকবে এবং তুলার প্রয়োজনীয় পরিচর্যা করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়৷ যশোর কুষ্টিয়া অঞ্চলের চাষিরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করছেন৷
আউশ ধানের সাথে তুলার চাষ: আউশ ধান পাকতে দেরি হলে তুলার বীজ সময় মত বুনতে হলে আউশ ধান কাটার আগেই ধানের গাছ বিলি করে দু’পাশে সরিয়ে লাইন করতে হয়৷ এই লাইন বরাবর ডিবলিং পদ্ধতিতে তুলার বীজ বপন করতে হয়৷ ধান কাটার পর কোদাল দিয়ে কুপিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হয় এবং প্রয়োজনীয় পরিচর্যা নিলে তুলার আশানুরূপ ফলন পাওয়া যায়৷ কুষ্টিয়া জোনের প্রাগপুর ও অন্যান্য ইউনিটের চাষিরা এই পদ্ধতি অবলম্বন করছেন৷
তুলার সাথে গমের চাষ: নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত তুলা ফসলের মাঝে গম বীজ বোনা যায়৷ এই সময় তুলার ২/১টি পিকিং হয়ে থাকে৷ বৃষ্টি হলে অথবা সেচ দিয়ে জমি ‘জো’ অবস্থা সৃষ্টির পর দু’লাইন তুলার মাঝে কোদাল দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিয়ে গম বুনতে হয়৷ পাশাপাশি তুলা উঠানো চলতে থাকে৷ গমের বীজ ১৪০ কেজি/হেক্টর হিসেবে বুনতে হয়৷ ইউরিয়া অর্ধেক, টিএসপি, এমওপি, জিপসাম যথাক্রমে ১৪০, ১৭৫, ৬০, ১০০ কেজি/হেক্টর বেসাল হিসেবে গমের জন্য পৃথকভাবে ব্যবহার করতে হয়৷ অবশিষ্ট অর্ধেক ইউরিয়া গমের চারার বয়স ১৫-২০ দিনের মধ্যে পার্শ্ব প্রয়োগ করতে হয়৷ জমিতে রস থাকলে ২১/২২ দিনের মাথায় ১টি সেচ দিলে চলে৷ কিন্তু রসের অভাব থাকলে একাধিক সেচ দিতে হয়৷ এতে একই সাথে তুলা ও গমের ভাল ফলন পাওয়া যায়৷
আখের সাথে তুলার চাষ: স্বাভাবিকভাবে শ্রাবণ মাসে তুলা বপনের পর মাঘ/ফাল্গুন মাসে তুলার সারির মাঝে নালা কেটে নিয়মমাফিক আখ লাগাতে হবে৷ এরপর তুলা পিকিং শেষে একটি সেচ দিয়ে ইউরিয়া সার স্প্রে করতে হয়৷ যশোর, কুষ্টিয়া, বগুড়া, রংপুর বিশেষ করে রাজশাহী জোনের বড়াল নদীর দু’পাশের এলাকাগুলোতে আখের সংগে তুলাচাষের ব্যাপক সম্ভাবনা লক্ষ্য করা যাচেছ৷